সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

জীবনযুদ্ধে হারনামানা একজন বিরঙ্গনার নাম মরিয়ম খাতুন।

অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে অনার্সে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে নওয়াপাড়ার মরিয়ম। নেই মাথা গোজার ঠাঁই, ভিক্ষুক মা আর বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন মরিয়ম খাতুনের। মরিয়ম খাতুন জীবনযুদ্ধে হারনামানা একজন বিরঙ্গনার নাম। চরম অভাবের যন্ত্রনা-ক্ষুধা দারিদ্রতার চুড়ান্ত সীমা পার করে ধিরে ধিরে এগিয়ে চলেছে সে। জন্মের পর থেকে শয্যাশায়ী বৃদ্ধ পিতা আর মস্তিষ্ক বিকৃত ভিক্ষুক মায়ের জীবন যন্ত্রনাকে সঙ্গি করে খেয়ে না খেয়ে বেড়ে উঠেছে নওয়াপাড়ার পাঁচকবর এলাকার সবার প্রিয় মরিয়ম খাতুন। মাথা গোজার ঠাঁই নেই মরিয়মদের। অন্যের জমিতে কোনরকম একটি কুড়ে ঘরে ভিক্ষুক মায়ের অন্যের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা উচ্ছিষ্ট খাবার আর ছেড়া বাদ দেয়া কাপড় পরে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলা সৈনিক মরিয়ম চরম মানবেতর জীবন যাপন করছে। এবার বিএল কলেজ থেকে অনার্সে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে গোটা নওয়াপাড়াবাসীসহ তার কলেজের শিক্ষক ও সহপাঠীদেরকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তার এ সাফল্যের খবরে দৈনিক নওয়াপাড়ার পক্ষ থেকে এ প্রতিবেদক গতকাল দুপুরে তার বাড়িতে উপস্থিত হয়। বাড়িতে যেয়ে দেখা যায় ভাঙ্গা ঘরের এক কোনে জোহরের নামাজ আদায় করছে মরিয়ম। বসতে দেয়ার জায়গা নেই ওদের। লাঠি ভর দিয়ে বেরিয়ে আসলেন মরিয়মের বৃদ্ধ বাবা শামছুর শেখ। মেয়ের খোঁজ নিতে আসার খবরে কেঁদে ফেললেন তিনি। বললেন, আমি যে কোন সময় মরে যাবো। আমার মেয়েকে কোথায় রেখে যাবো বাবা। কাঁপতে কাঁপতে মাটিতেই বসে পড়লেন বৃদ্ধ। নামাজ শেষ করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো মরিয়ম। চোখে পানি টলমল করছে। হয়তো নামাজ শেষে শ্রষ্টার কাছে অসহায় মা-বাবার জন্য ফরিয়াদ করছিলো সে। ছালাম বিনিময় করে বসতে দিতে না পারার লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছিল সে। ভালো রেজাল্টের উচ্ছাস এক মিনিটেই মিইয়ে গেলো মরিয়মের। পাশে দাড়ানো মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মরিয়ম। “আমার মা-বাবা একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারেনা। তিনবেলা ঠিকমত খাবার জুটাতে পারিনা। রোগের যন্ত্রনায় সারারাত নির্ঘুম কেটে যায় তাদের। আর সেই যন্ত্রনা আমার সকল সাফল্যকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। আমি কি করবো তা ভাবতেও পারিনা। স্থানীয়দের সহায়তায় এ পর্যন্ত এসেছি।” কাঁদতে কাঁদতে বলে চললো মরিয়ম, “প্রায়ই পত্রিকার খবরে পড়ি আমাদের ডিসি সাহেব অসহায় শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়ান। তাদের লেখাপড়ার খরচের ভার বহন করেন। তিনি যদি আমার জন্য একটু মাথা গোজার ঠাই করে দিতেন। সামান্য এক খন্ড জমি আর একটি কুড়ে ঘর ব্যবস্থা করতেন।
 যে ঘরে আমার মা- বাবা নিরাপদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারতেন। মৃত্যুর আগে তারা অন্তত এটুকু শান্তনা নিয়ে যেতেন যে তাদের একমাত্র মেয়ের জন্য একটু মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে। এছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। আর কোন স্বপ্ন নেই।” ঢুকরে কেঁদে উঠলো মরিয়াম। আর কোন কথা বলতে পারলোনা। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানাগেছে, ওই এলাকার কাইয়ুম আলীর জমিতে ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে মা-বাবাকে নিয়ে বসবাস করে মরিয়াম। জন্মের পর থেকে অসহায় মস্তিষ্ক বিকৃত মায়ের ভিক্ষা ও অন্যের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা খাবারে বড় হয়েছে মরিয়ম। নওয়াপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শুরু করে স্থানীয়দের সহায়তায় ও মায়ের সারাদিনের ভিক্ষার টাকায় ২০০৭ সালে বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.০০ পেয়ে এসএসসি পাশ করে মরিয়ম। এবং ২০০৯ সালে নওয়াপাড়া মডেল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৪.১০ পেয়ে এইচ এসসি পাশ করে সে। ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে মরিয়ম। এসএসসি পাশ করার পর এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সামান্য পারিশ্রমিকে পড়াতে শুরু করে, পাশাপাশি চলে ঝিয়ের কাজ। এখনও ঝিয়ের কাজ করতে হয় তাকে। সেই সাথে কয়েকটি টিউশনি করে কোন মতে চলে তার লেখাপড়া। স্মৃতিভ্রষ্ট মাকে আর ভিক্ষা করতে যেতে দিতে চায়না মরিয়ম। না জানি কবে রাস্তা ভূলে হারিয়ে যায় তার জনম দুঃখিনী মা এই আশংকায় দিন কাটে মরিয়মের। এই সমাজের কাছে, দেশের সরকার প্রধানের কাছে এবং বিশেষ করে যশোরের জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীরের কাছে তার ছোট্ট একটি চাওয়া। কোন রকম একটি চাকরী আর একটু মাথা গোজার ঠাঁই। তাহলেই পরম তৃপ্তিতে মা-বাবার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবে মরিয়ম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for comments