রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৫

এরাই পতিতা? নাকি, এ সমাজ পতিতা?



কয়েকদিন আগে মাদারীপুরের পতিতাপল্লী উচ্ছেদ করা হয়েছে এলাকাকে পাপ কাজ থেকে উদ্ধার করতে এবং সমাজকে কলুষমুক্ত রাখতে। বেশ ক'বছর আগে নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থেকেও এভাবেই উচ্ছেদ করা হয়েছিল যৌনকর্মীদের এবং তারপরের ঘটনা আমরা সবাই জানি। 
এসব যৌনকর্মী ছড়িয়ে পড়েছিল রাস্তাঘাট, আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে হোটেল এবং বস্তিতেও। একটা এলাকাকে পাপমুক্ত করতে গিয়ে গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমি কোনোভাবেই এই পেশার পক্ষে নই। কিন্তু সমাজের সুধীজনদের একটু ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।
  • একটা মেয়ে কতটুকু বিপদে পড়লে বা কোন অবস্থায় নিজেকে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত করে বা আদৌ তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় এ পেশায় যুক্ত হয় কি-না?
  • রাষ্ট্র বা সমাজ যতদিন পর্যন্ত এসব হতভাগা মেয়ের জীবিকা নির্বাহে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না করবে, ততদিন পর্যন্ত কোনো ভাবেই এ পেশাকে নির্মূল করা সম্ভব কি?
  • যদি তা না হয় তাহলে ২-১টি পল্লী উচ্ছেদ করে এসব মেয়েকে ভাসমান করে পুরো সমাজটাই কি পতিতাপল্লী হয়ে উঠবে না?
যেসব সুধীজন এই অসাধারণ সমাজ কল্যাণমূলক ভালো কাজটি করে বাহবা কুঁড়িয়েছেন তাদের কাছে আমার সবিনয়ে কিছু প্রশ্নঃ

১.  এখানে যেসব মেয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের কতজন স্বেচ্ছায় এবং শখ করে এ কাজ করছে?

২. নাকি ভদ্রবেশী শয়তানদের লোভ-লালসার শিকার হয়ে বাধ্য হয়েছে এই পথে আসতে?

৩. এসব মেয়েকে সমাজ, সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাম দেওয়া হয়েছে পতিতা। কিন্তু যারা এ জায়গায় বিকৃত লালসা পূরণ করতে যান, তাদের কি পতিত বলা হচ্ছে কি-না?

৪. উচ্ছেদের মত মহৎ উদ্যোগে তাদের কি চিহ্নিত করে কোনো শাস্তি দেওয়া হবে?

৫. পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশের আইনে অবৈধকোনো পেশা নয়। সরকারি আইন মেনে রীতিমতো রেজিস্ট্রেশন করে এ পেশায় আসতে হয় এবং পতিতা পল্লীর সব মেয়েই রেজিস্ট্রিকৃত পেশাদার এবং তাদের ভোটাধিকার রয়েছে। তাহলে কেন এবং কার স্বার্থে এই উচ্ছেদ?

আমরা সব সময়ই লক্ষ করি, নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন এলাকায় নব্য সমাজকর্মী বা ভালো মানুষের আবির্ভাব ঘটে যারা নিজেদের ভালো জাহির করতে এসব তথাকথিত কাজগুলো করে নিজেদের জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়টি আমরা এর আগে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের সময়ও দেখেছি। 

যতদূর জানি, হাইকোর্টের একটি নিষেধাজ্ঞা ছিল এই পল্লী উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। তারপরও দিনদুপুরে সবার সামনে এই বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে। তাহলে আইন আর প্রশাসন কি এতই দূর্বল, নাকি আইন সবার জন্য সমান নয়? বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে_ ধর্ম-বর্ণ, পেশা বা অন্য কোনো কারণে কারও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা যাবে না বা কারও বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। 

কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা এর কোনোটারই প্রয়োগের কথা এখন পর্যন্ত শুনিনি। একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌবন্দরে পতিতাপল্লী ছিল, এখনও টাঙ্গাইল, দৌলতদিয়া এবং খুলনায় বড় পতিতালয় আছে। এখানে মূলত যেসব মেয়ে এ পেশায় এসেছে তাদের বেশির ভাগই প্রতারণা এবং পাচারের শিকার হয়ে এসেছে। 
অনেকে আবার মায়ের উত্তরাধিকারের সূত্র ধরে এ পেশায় এসেছে বা আসছে। মূলত এখানে যেসব মেয়ে আছে তারা কেউই স্বাধীন নয়, এরা বাড়িওয়ালি, দালাল এবং সমাজপতিদের হাতে জিম্মি। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এদের আয়ের একটা বড় অংশ বাড়িওয়ালি, দালাল আর সমাজপতিদের পকেটে যায়, এর বাইরে যা থাকে তা খুবই সামান্য এবং তা দিয়ে কোনোমতে জীবিকানির্বাহ করে তারা। 

আরও মজার বিষয় হচ্ছে, এরকম অনেক মা-বাবা আছেন, তারা মেয়ের পেশাকে জেনেও তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নিচ্ছেন; কিন্তু তাকে মেয়ের মর্যাদা দিচ্ছেন না। কারণ, সার্থের কোনো রঙ নেই। আমরা প্রতিনিয়ত নানা অন্যায়, অসততা, চুরি, ঘুষ খাচ্ছি। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আছি। সমাজের উঁচুতলায় ওঠার জন্য নিজের স্ত্রী বা মেয়েকে অন্যের ভোগের শিকার করছি। কিন্তু আমরা পতিত হই না। আমাদের পার্টির জৌলুস বাড়ানোর জন্য সোসাইটি গার্ল আমাদের স্ট্যাটাস বাড়ায়। 

আর ওইসব আধপেটা খাওয়া ততধিক দরিদ্র, অপুষ্ট নোংরা মেয়ে গুলো পেটের দায়ে অথবা বাধ্য হয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় তার দেহ বিক্রি করে, তাতে আমাদের সমাজ নোংরা হয়ে যায়, যার খদ্দের আবার আমরাই। পরিশেষে একটা গল্প বলি, যদিও এটা সত্য ঘটনা রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাশিয়া সরকার একটা কাজ করেছিল, সেখানকার পতিতা পল্লীতে যারা যেত তাদের সবার নাম, ছবিসহ বাসার ঠিকানা লেখা বাধ্যতামূলক ছিল এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর সেসব নামের তালিকা, ঠিকানা ও ছবি প্রকাশ করা হতো জনসমক্ষে। এর কিছুদিন পর দেখা গেল, ওইসব পল্লীতে আর খদ্দের পাওয়া যাচ্ছে না। 

এক সময় খদ্দেরের অভাবে পল্লীর মেয়েরা এ পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া হলো। আমরা তথাকথিত সুধীজনরা সবসময়ই অন্যের দিকে আঙুল তুলে বেড়াই। 

কখনোই কোনো ক্ষেত্রে নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখি না। এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ব্যাধির উৎস নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই এবং ব্যাধিমুক্ত হওয়ারও কোনো ইচ্ছা নেই, তাই একটি নির্দিষ্ট জায়গার ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for comments