বুধবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৫

আমিই সেই মেয়ে।


আমিই সেই মেয়ে। বাসে ট্রেনে রাস্তায় আপনি যাকে রোজ দেখেন যার শাড়ি, কপালের টিপ কানের দুল আর পায়ের গোড়ালি আপনি রোজ দেখেন। আর আরও অনেক কিছু দেখতে পাবার স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে যাকে ইচ্ছে মতন দেখেন। আমিই সেই মেয়ে। 

বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে দিনের আলোয় যার ছায়া মাড়ানো আপনার ধর্মে নিষিদ্ধ, আর রাতের গভীরে যাকে বস্তি থেকে তুলে আনতে পাইক বরকন্দাজ পাঠান আপনি আর সুসজ্জিত বিছানায় যার জন্য অপেক্ষায় অধীন হয় আপনার রাজকীয় লাম্পট্য আমিই সেই মেয়ে। 

আমিই সেই মেয়ে-আসামের চাবাগানে ঝুপড়ি কামিন বস্তি থেকে যাকে আপনি নিয়ে যেতে চান সাহেবি বাংলোয় মধ্যরাতে ফায়ার প্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় মদির চোখে দেখতে চান যার অনাবৃত শরীর আমি সেই মেয়ে। 

রাজস্থানের শুকনো উঠোন থেকে পিপাসার জল আনতে যাকে আপনি পাঠিয়ে দেন দশ মাইল দূরে সরকারি ইঁদারায়- আর কুড়ি মাইল হেঁটে কান্ত বিধ্বস্ত যে রমণী ঘড়া কাঁখে ঘরে ফিরলেই যাকে বসিয়ে দেন চুলার আগুনের সামনে আপনার রুটি বানাতে আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- যাকে নিয়ে আপনি মগ্ন হতে চান গঙ্গার ধারে কিংবা ভিক্টোরিয়ার সবুজে কিংবা সিনেমা হলের নীল অন্ধকারে, যার চোখে আপনি একে দিতে চান ঝুটা স্বপ্নের কাজল আর ফুরিয়ে যাওয়া সিগারেটের প্যাকেটের মত যাকে পথের পাশে ছুঁড়ে ফেলে আপনার ফুল সাজানো গাড়ি শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করতে ছুটে যায় শহরের পথে- কনে দেখা আলোর গোধুলিতে একা দাঁড়িয়ে থাকা আমিই সেই মেয়ে।

আমিই সেই মেয়ে- এমন কি দেবতারাও যাকে ক্ষমা করেন না। অহংকার আর শক্তির দম্ভে যার গর্ভে রেখে যান কুমারীর অপমান আর চোখের জলে কুন্তী হয়ে নদীর জলে বিসর্জন দিতে হয় কর্ণকে আত্মজকে। আমিই সেই মেয়ে। 

সংসারে অসময়ের আমিই ভরসা। আমার ছাত্র পড়ানো টাকায় মায়ের ওষুধ কেনা হয়। আমার বাড়তি রোজগারে ভাইয়ের বই কেনা হয়। আমার সমস্ত শরীর প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। কালো আকাশ মাথায় নিয়ে আমি ছাতা হয়ে থাকি। ছাতার নিচে সুখে বাঁচে সংসার।

আপনি, আপনারা আমার জন্য অনেক করেছেন। সাহিত্যে কাব্যে শাস্ত্রে লোকাচারে আমাকে মা বলে পুজো করেছেন। প্রকৃতি বলে আদিখ্যেতা করেছেন- আর শহর গঞ্জের কানাগলিতে ঠোঁটে রঙ মাখিয়ে কুপি হাতে দাঁড় করিয়েও দিয়েছেন। হ্যা, আমিই সেই মেয়ে। 

একদিন হয়ত- হয়ত একদিন- হয়ত অন্য কোন এক দিন আমার সমস্ত মিথ্যে পোশাক ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমিই হয়ে উঠবো সেই অসামান্যা। খোলা চুল মেঘের মত ঢাকবে আমার খোলা পিঠ। দু চোখে জ্বলবে ভীষণ আগুন। কপাল-ঠিকরে বেরুবে ভয়ঙ্কর তেজরশ্মি। হাতে ঝলসে উঠবে সেই খড়গ। দুপায়ের নুপুরে বেজে উঠবে রণদুন্দভি। নৃশংস অট্টহাসিতে ভরে উঠবে আকাশ। দেবতারাও আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে বলতে থাকবেন মহামেঘপ্রভাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং কালিকাং দক্ষিণাং মুণ্ডমালা বিভুষিতাং। বীভৎস দাবানলের মত

আমি এগোতে থাকবো। আর আমার এগিয়ে যাবার পথের দুপাশে মুণ্ডহীন অসংখ্য দেহ ছটফট করতে থাকবে- সভ্যতার দেহ, প্রগতির দেহ, উন্নতির দেহ, সমাজের দেহ। হয়ত আমিই সেই মেয়ে। হয়ত, হয়ত, বা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for comments